চলচ্চিত্র আবার দাঁড়িয়ে যাবে

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১৭, ২০১৫ সময়ঃ ৪:২১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৪:২১ অপরাহ্ণ

chasiচলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভাবনাটা কী। কী অবস্থায় আছি আমরা?
চলচ্চিত্র নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা খুবই দুরবস্থার মধ্যে আছি। আজ নতুন ছেলেমেয়ে যারা কাজ করছে, তাদের অনেকেই পথভ্রষ্ট। চলচ্চিত্র তো একটা উপন্যাস। লোকে বই পড়ে আর কেউ ফিল্ম দেখে। চলচ্চিত্র এমনভাবে তৈরি হয়, যেন মনের মধ্যে ঘটনা গেঁথে যায়। সেই উপন্যাস কোথায়? আজকাল যাকে জিজ্ঞেস করি, সে-ই বলে আমি গল্পকার, চিত্রনাট্যকার। সবাই স্ক্রিনপ্লে রাইটার আর পরিচালক হয়ে গেছে। কিন্তু ফিল্ম কোথায়? ফিল্ম আর ডিজিটাল ফিল্ম—এই দুয়ের অর্থ কী, এই ব্যাখ্যাটা এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে দিতে পারল না।
কিন্তু সারা পৃথিবীতে তো ডিজিটাল ফিল্ম হচ্ছে…
এটারও কিন্তু ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কিছু লোক এ ধরনের কথা খাওয়ানোর চেষ্টা করে। হলিউড বা বলিউডে ছবি করা হয় ৩৫ মিমি ক্যামেরায়। তারপর সেটা ভালো রং আর শব্দের জন্য ডিজিটালে রূপান্তর করা হয়। আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, যারা নতুন ডিজিটাল নামের ফিল্ম নির্মাতা হয়েছে, তারা কেউই বলতে পারবে না কীভাবে চলচ্চিত্র বানানো হয়। সে জন্যই বলছি, ফিল্ম যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে আবার ৩৫ মিমিতে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু এফডিসির যে হাল…
আমাদের এফডিসি! এটাকে দেখলে মনে হয় যেন ভূতের বাড়ি! কেউ কি এখন এফডিসিতে শুটিং করতে যায়? এফডিসি তো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। এফডিসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে ধার করে। এই টাকাটা কার? আপনার আমার মতো জনগণের টাকা। কিন্তু এই এফডিসিতেই অন্যতম সেরা ল্যাবরেটরি ছিল। এখন তার অবস্থা নাই-বা বললাম। যারা চলচ্চিত্র বোঝে না, তারা কেন এফডিসির পদে থাকবে? এটা তো আমলাদের জায়গা নয়। নন-টেকনিক্যাল মানুষ কেন ফিল্ম করপোরেশনে এমডি পদে থাকবে? এফডিসি ভাড়ার দোকানদার। দোকান বানিয়ে রেখেছে কোনো মালামাল নেই। আবার যেসব মালামাল আছে, তার দাম বাইরের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। তাহলে কেন নির্মাতারা এফডিসিতে কাজ করবে? এটা অবশ্য একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
chasi2মানুষ সিনেমা হলে যাওয়াটাই ভুলে গেল কেন?
এখন যেসব ছবি নির্মাণ করা হচ্ছে, তার প্রায় সবই ভারতীয় গল্প। স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেটের কারণে এখন কাউকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এখন ভারতীয় ছবি নকল করে বাংলা ছবি বানানো হচ্ছে। ধরা যাক, সালমান খানের ওয়ান্টেড ১০০ কোটি টাকা বাজেটের ছবি। সে টাকাও তুলে আনা যাচ্ছে। আমাদের পরিচালকেরা এক কোটি টাকায় ছবি বানাচ্ছে। এক কোটি টাকা দিয়ে কি ১০০ কোটি টাকার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব? দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের প্রতি অনুভূতি, মায়া-মমতা নেই। আজ যে কেউ কাউকে শ্রদ্ধা করবে, তা একেবারেই উঠে গেছে।
এটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
আমরা দেশ পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু দেশপ্রেম আমাদের নেই। অবস্থা এমন, দেশ তো পেয়েছি, এখন শুধু লুটপাট করো। এই জিনিসটা আমার কাছে অবাক লাগে।
দেশপ্রেম যে নেই বললেন, এখন যারা বাচ্চা, তারা দেশপ্রেম অনুভব করবে কী করে?
হবে না। হবে না। দেশপ্রেম অনুভব করার প্রশ্নই ওঠে না। জাতি দুভাগে বিভক্ত। নতুন প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করে দিচ্ছি তো আমরা। কারণ দেখেন, আমি আমার সন্তানকে কাল বলছি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, আবার পরশু দিন বলছি, এই শোনো, জিয়াউর রহমান কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষক। এই অবস্থা কত দিন চলবে? দুই দিন, চার দিন? এভাবে চলতে পারে না। সে জন্যই বলছি, আরেকটা যুদ্ধ হতেই হবে।
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওরা ১১ জন ছবির একটি দৃশ্যযুদ্ধ হবে কী করে?
মিথ্যা বলতে বলতে একসময় ওরাও ক্লান্ত হয়ে পড়বে। যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন কিন্তু আর কিছু মানা সম্ভব হয় না। তাই যেকোনো উপায়ে সত্য বেরিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিন্তু একটা গ্রুপ ছিল আমাদের দমিয়ে রাখার জন্য। আমরা কি তখন বেরিয়ে আসিনি? চীন, আমেরিকা আমাদের বিপক্ষে ছিল, তার পরও কিন্তু আমরা বেরিয়ে এসেছি। জনগণ যদি একবার জেগে ওঠে, তাহলে কেউ আর দাবিয়ে রাখতে পারে না।
আচ্ছা আমাদের এখানে জামায়াত আবার সংগঠিত হতে পারল কী করে?
আমি কথা প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কেন শাহ আজিজকে দলে নিলেন? জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, সংসদে তাঁর মতো তুখোড় সাংসদ দরকার। আজিজের সঙ্গে জামায়াতের কিছু লোক আছে। কিন্তু জামায়াতের প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই। রাজাকার আলবদর যারা আছে, তারা কিন্তু চিহ্নিত, তাহলে তাদের বিচারে এত দেরি হচ্ছে কেন? মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আদালত করা হয়েছে। আদালতে যাবে, বিচার হবে—হয় ছেড়ে দেবে, না হয় ফাঁসি দেবে। এটাই নিয়ম। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কথায় আইনই পাল্টাল, তার পরও ফািঁস দিতে পারছে না! আমার কথা হচ্ছে, ফাঁসি দিয়ে দিলে কীই-বা এমন হবে? কিচ্ছু হবে না। কিন্তু রাজনীতির কারণে ফাঁসি হচ্ছে না। এটা রাজনীতি। আমি তো মনে করি, ওদের ফাঁসি হলে কেউ কোনো কথা বলবে না। আশায় তো প্রত্যেক মানুষ বাঁচে, আমরাও চাই অনন্ত সুন্দর একটি দেশ হোক।
আপনি কি মনে করেন এই দুই দল একসময় একসঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে?
অবশ্যই ভাববে। ভাবতে তারা বাধ্য হবে। কোনো উপায় থাকবে না। হয়তো আমরা সেদিন থাকব না।
একাত্তরের আগে আমরা অনেক মিছিল-মিটিং করেছি না? তখন অনেকেই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করেছে। তাই বলে কি সবকিছু থেমে ছিল? দেশ কিন্তু লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে।
চলচ্চিত্র নিয়ে কোনো স্মৃতির কথা বলবেন?
শেখ মুজিব কিন্তু আমার ছবিতে অভিনয় করেছেন।
কোন ছবি?
সংগ্রাম ছবির শেষ দৃশ্যে তিনি অভিনয় করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে করেছিলেন নেহরু, দিল্লি দূর নেহি ছবিতে।
গল্পটা একটু বলবেন?
আমি সংগ্রাম ছবির শেষ দৃশ্যের শুটিং করব। আর্মিরা স্যালুট দেবে আর তিনি (শেখ মুজিব) স্যালুট নেবেন। মার্চপাস্টে যেটা হয়। খসরু বলল, ‘চলেন যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে।’ সোজা বঙ্গবন্ধুর রুমে চলে গেলাম। বঙ্গবন্ধুকে খসরু বলল, ‘আপনার কাছে একটা কাজে আইছি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী কাজ? ক?’ খসরু বলল, ‘আমরা এই রকম একটা দৃশ্য করব, আপনি স্যালুট নিবেন।’ বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ, আমি ফিল্মে অ্যাক্টিং করব না।’ খসরু বলল, ‘এটা তো অ্যাক্টিং হইল না।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অ্যাক্টিং হইল না কী?’ তখন খসরুকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বললেন। খসরুও নাছোড়বান্দা। ‘না আপনাকে করতেই হবে। আপনি না হলে সিনেমাটা শেষ করতে পারব না।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মান্নানরে ডাক।’ (তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান)। আমরা অন্য রুমে গিয়ে বসলাম। মান্নান সাহেব এলেন। জানতে চাইলেন কারণ। তখন খসরু বলল, ‘বঙ্গবন্ধুরে অ্যাক্টিং করতে হইব।’ মান্নান সাহেব বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাক্টিং করব, এ-ও সম্ভব?’ খসরু বলল, ‘সম্ভব না হইলে আপনারে দাঁড় করাইয়া দিমু।’ আমি তো অবাক। খসরু আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মান্নানকে বলল, ‘বঙ্গবন্ধুরে যেন উল্টাপাল্টা কিছু বইলেন না। বলবেন, অ্যাক্টিং করা যায়।’ তারপর মন্ত্রীর সঙ্গে আমরাও ভেতরে যাই। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী তাইলে?’ ‘ওই ঠিকই আছে। তয় করবেন কবে?’ তখন বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন কাজটি করে দিতে। বললেন, ‘যা, করে দেব।’ আমরা পিলখানায় কাজটা করি। সব প্রস্তুতি নিই। যে পরিমাণ আয়োজন, এটা একবার মিস হইলে শেষ। আজকাল ইতিহাস পরিবর্তন নিয়ে সবাই ঝগড়া করে। কিন্তু কেন করে? জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফসহ সবাই বঙ্গবন্ধুর পেছনে লাইন ধরে বসা। এত ঘনিষ্ঠ তাঁরা! কেন এখন সবাই একেক ধরনের কথা বলছে! বঙ্গবন্ধু স্যালুট গ্রহণ করলেন। একপর্যায়ে জানতে চাইলেন, ‘এই, কতক্ষণ হাত তুইলা রাখব রে।’ আমি তখন বললাম, ‘আর অল্প কিছুক্ষণ।’ তিনি বললেন, ‘আরে কী করস না করস তোরা।’ বঙ্গবন্ধু কী যে হেল্প করলেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার আশা…
আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। চলচ্চিত্রের দিকে সরকারের একটু নজর দিতে হবে। যোগ্য লোক এফডিসির এমডি হতে হবে। নতুন যারা কাজ করছে, তাদের মধ্যে একেবারে ট্যালেন্ট যে নেই, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ হয়তো বেরিয়ে আসবে। ফিল্ম আর ডিজিটাল ফিল্মের যে কম্পোজিশন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। যারা টিভি থেকে ইদানীং চলচ্চিত্রে এসেছে, চলচ্চিত্র বানাচ্ছে, তাদের কাজ নাটকের মতো। তবে তারাও এখন কিছুটা বুঝতে পারছে বলে মনে হয়। সামনে হয়তো তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু সৃষ্টি পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারটি শুধু এফডিসি-কেন্দ্রিক না হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। এফডিসিও বাধ্য হবে নিজেদের পরিবর্তন করতে।
আপনার প্রিয় কবিতা?
জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’।
প্রিয় গান?
‘জীবন সে তো পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু’।
উপন্যাস?
সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম।
প্রিয় সিনেমা?
ক্রেইনস আর ফ্লাইং। রুশ পরিচালক মিখাইল কালাতোজভের অসাধারণ সিনেমা। সে সিনেমা বলে দেয়, যুদ্ধ দরকার নেই। এই ছবির অসাধারণ শটগুলো কে না চুরি করেছে? এই যেমন মাথা ঘুরছে গুলি লাগার পর! আমরা সব চোর, হা হা হা! তার পরও তো এগিয়ে এসেছি। আগে বছরে তিনটা-চারটা ছবি মুক্তি পেত। আশির দশকে আমরা ১১০টা ছবিও রিলিজ দিয়েছি। এটা কম কথা নয়। তার পরেও বলতে হবে, সব জায়গায়ই তো দুই নম্বরি চলছে। কিন্তু আমি জানি, চলচ্চিত্র আবার দাঁড়িয়ে যাবে। আবার অনেক ছবি মুক্তি পাবে। বেশি ছবি মুক্তি পেলে প্রতিযোগিতা আসবে। প্রতিযোগিতা এলে ভালো ছবি হবে।
সহযোগিতায়: মনজুর কাদের

souce-prothom-alo

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G